বিজয়ফুল : এইতো সময়

নব্বুই সালে বিলেতে পড়াতে আসার পর যাঁর সঙ্গে পায়ে হেঁটে হেঁটে চিনেছি আমাদের মানুষ, জেনেছি মুক্তিযুদ্ধের সময়ে লন্ডন লেগুনের সব লাল, শুনেছি কি ভাবে একাত্তর সালে বিলেতে বাঙ্গালীরা একটি স্বাধীন দেশ প্রতিষ্ঠায় প্রাণপাত করেছিলেন- তাঁর নাম তাসাদ্দুক আহমদ এমবিই । তিনি ছিলেন বিলেতে বাংলাদেশী সমাজের প্রাণ পুরুষ।


তাঁর শঙ্কাও ছিল। আগামী প্রজন্মের আত্মস্বত্ত্বা চেতনা লুপ্তির, শেকড় খোয়ানোর, স্বকীয় ইতিহাস, ভাষা, সংস্কৃতিবিস্মৃতির। আমার প্রবাস পিতা প্রয়াত হলে কখন এ সবকিছু চড়ে বসলো আমার পিঠে জানিনা। এদিকে দেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট পাল্টে যেতে লাগলো। আশঙ্কা ভীতিতে রূপান্তরিত হতে থাকলো।তখন একদিন এক শীতার্ত সন্ধ্যায় পাতাল রেলের বলয়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধাহত এক সৈনিকের কাছ থেকে কিনেছিলাম টুকটুকে লাল একটি কাগজের পপি ফুল। মনে পড়ে গেল আমাদের জাতীয় বীর, মুক্তিযোদ্ধাদের কথা।

বাড়ি ফিরেই ভাবনাগুলো ঢাকার জনপ্রিয় দৈনিক জনকন্ঠ কাগজে কর্মরত স্নেহ ভাজন আরিফ রহমান শিবলির কাছে পাঠাই। শিরোনাম ছিলো‘পলাশ নয়তো কৃষ্ণচূড়ার নামে’। ছাপা হওয়ার পর সে কি ব্যপক সাড়া! পাঠকের প্রতিক্রিয়াআমার চিন্তাকে দিলো আরো উষ্কে। এবার বর্ধিত ভাবনা লিখলাম বিলেতের জনপ্রিয় সাপ্তাহিক জনমতে। বাংলাদেশে ততদিনে রাজনীতির কৌশল ও করাতে আমাদের নতুন প্রজন্ম হয়ে যাচ্ছে বিভ্রান্ত। জানি, কাঁচাতে না নোয়ালে বাঁশ পরে করে ঠাস্ ঠাস। আসলে শৈশব থেকেই ধর্মের মত, সংস্কৃতির অংশ করে, সামাজিক আচারের মাধ্যমে দেশপ্রেমকে প্রোথিত করতে হয়। কি করা যায়? কখন? এখন- নইলে কখন!

তখন টমাস বাক্সটন প্রাইমারি স্কুলে শিক্ষকতা করি। স্কুলের বাঙালি শিক্ষার্থীদের নিয়ে শুরু করলাম পরীক্ষা-নিরীক্ষা। খুঁজতে লাগলাম মাতৃভূমি, স্বজাতি ও উত্তরাধিকার সনাক্ত করাবার একটা সহজ উপায়। ভূগোলের ক্লাশে আন্ত:পাঠ্যসূচীর সুযোগে জাতীয় ফুল শাপলা নিয়ে গল্প বলে বুঝি, কাজ হবে। ছোট ছোট হাতের পাঁচটি সবুজ ও একটি লাল বৃত্তের খেলায় ফুল ফুটলো। পাপড়িগুলোর প্রতীকি ব্যাখা হল। তখন গ্রাফিক ডিজাইনার কন্যা ঈশিতা আজাদ করে দিল এর নক্শা। ১৯৭১ এর ডিসেম্বরে বিজয়ের ফুল ফুটেছিলো বলে এর নাম দিলাম ‘বিজয়ফুল’। সম্ভবত তা ছিলো ২০০২ সাল।

এরপর বিজয়ফুল কর্মসূচিতে প্রাণদায়ী প্রণোদনা নিয়ে এগিয়ে আসলেন মুক্তিযোদ্ধা মাহমুদ হাসান, লোকমান হোসেইন, আবু মুসা হাসান, খলিল কাজী এমবিই ও লিমন চৌধুরী প্রমূখ। এ্লেন নির্মূল কমিটির আনসার আহ্মদ উল্লাহ, লন্ডন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের মিলটন রহমান, এস এম জাকির হোসাইন, খাদিজা রহমান, শোয়াইব চমক,, আরফুমান চৌধুরী, সংহতি সাহিত্য পরিষদের ইকবাল হোসেইন বুলবুল, আনোয়ারুল ইসলাম অভি, চ্যানেল এস টিভির সুবাস দাস, মুক্তিযোদ্ধা তনয়া সোহানা চৌধুরী সহ একদল তরুন ত্রুনী। এরা এসেই ফুলটির রং ও ডিজাইন মোডিফাই করা থেকে শুরু ওয়েব সাইট নির্মান, কর্মসূচি ভিডিও করণ করে ইউটিউবে ছাড়া সহ জোড়ালো ক্যাম্পাইন করতে লাগলেন। চ্যানেল এস টিভি পাশে এসে দাঁড়ালো। দেশে, কালের কন্ঠ প্ত্রিকায় লিখলেন আরিফ জেবটিক।

২০০৭ এ এর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হল। ২০০৯ এ এর স্বীকৃতি দিল টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিল। ২০১০ এর ত্রিশ নভেম্বর রাত বারোটা এক মিনিটে বিলেতে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত ড সাইদুর রহমান খান সারা বিশ্বের জন্য বিজয়ফুল কর্মসূচির উদ্বোধন করলেন। সে রাতে তাপমাত্রাছিলো হিমাংকের নিচে। প্রতিকূল অবস্থা উপেক্ষা করেই পূর্ব লন্ডনের আলতাব আলী পার্কে জড়ো হন মুক্তিযোদ্ধাগন ও নানান স্তরের মানুষ। কপিরাট করার পর ২০১২ তে বাংলাদেশেও সূচিত হল এ কর্মসূচি। তারপর ডিসেম্বর আসা মাত্র দেশে ও বিদেশে জমে উঠতে থাকলো মুক্তিযুদ্ধের গল্প বলে বলে ফুল বানানো, বিনিময় ও পরা। আমরা বিস্মীত হয়ে দেখলাম একটি কাগজের ফুল প্রতীকে কত কথা যায় - যা সম্ভব হয়নিকোনো ব্যাজে, ধাতবে, মালায়, বক্তৃতা ও নৃত্যে-গীতে।

এ ফুল দল-মত নির্বিশেষে একাত্তরের চেতনায় বিশ্বাসী বিশ্ববাসীকে যুথবদ্ধ করে তোলার সুযোগ এনে দিয়েছে। ডিসেম্বরের একথেকে ষোল তারিখ প্রতিদিন আমরা এ ফুল ধারণ করছি বুকের বাঁ পাশে। ১৯৯৮ থেকে আজ অবধি যে ব্যাক্তি, যাঁরা, যত সাংগঠন ও মানুষ এ যাত্রাটিকে‘ আমাদের সবার যাত্রা’ করে বৈশ্বিক পর্যায়ে নিয়ে এসেছেন এ কৃতিত্ব তাদের।


একদিন প্রবাসে তুষারের তমসা চিরে মুক্তিযুদ্ধের গল্পের আগুনে হাত সেঁকেছিলাম আমরা। আজ সে উষ্ণতা আলিঙ্গনে আবদ্ধ করছে কত শত জনকে! ‘বিজয়ফুল’ হয়ে উঠেছে বুকে ধরা লাখো শহীদের এক অনন্য স্মারক - অমূল্য মুক্তিযুদ্ধের প্রতীক, একাত্তরের জন-যুদ্ধের গাঁথা, লাল-সবুজের আমাদের দেশ-মাতৃকার মুখ।

শামীম আজাদ

নভেম্বর ২০১৭

লন্ডন